সময়ের মূল্যায়ন সফলতা ও ব্যর্থতা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আল্লাহ প্রদত্ত সব নেয়ামতের মধ্যে সময় এক অতুলনীয় শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা সময় নামক একটি সূরা ‘আসর’ নাজিল করেছেন। তিনি সময়ের কসম করে গোটা মানব জাতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন, যাতে মানুষ নিমেষেই জানতে পারে কিসে সাফল্য আর কিসে ধ্বংস। মানুষের পরিচিত ‘সময়’ জ্ঞাপক শব্দে তিনি কসম করেছেন। ‘ফালাক’ দোহা সকাল বেলা, প্রখর রোদের দুপুর বেলা, ‘আসর’ পড়ন্ত বেলা, সন্ধ্যা বেলা, গভীর রজনী, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চাঁদনী রাত, সূর্যের কিরণ এবং দিন ও রাতের কসম করে তিনি সময়ের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। কারণ সময়ের সমষ্টিই জীবন। সময়ের প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাইয়্যুম (রহ.) বলেছেন, ‘জীবনের যে সময়টুকু অতীত তা শুধুই স্বপ্ন, যা অবশিষ্ট আছে তা আশা-আকাক্সক্ষা, আর সময় উভয়ের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।’ সময়ের অগ্রাধিকার সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মোমিনদের থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।’ (সূরা তওবা : ১১১)।

এ আয়াতে ধনসম্পদের আগে স্থান পেয়েছে সময় ও জীবন। সম্পদের মতো সময়কে একই সমীকরণে গ্রহণ না করলে কেউ ব্যবসায় সফল হতে পারে না। এ ধারণা নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা শুরু করে থাকে। আমরা কাউকে অর্থ-সম্পদ চুরি করতে দিই না; কিন্তু আমরা সময় চুরি বা ক্ষেপণ হতে দিই। এ পৃথিবীতে মানুষের সময় ও জীবন হচ্ছে পরম পাওয়া আল্লাহর অনুগ্রহ। সময়ের মালিক আল্লাহ তায়ালা নিজেকে ‘হুয়াল আউয়ালু ওয়াল আখিরু’ বলেছেন, মালিকের দেওয়া সময় ও জীবন দুনিয়ার কোনো ফিতা দিয়ে মাপা যায় না যার নাম আখেরাত। এ আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে ‘তিনি শুরু ছাড়া প্রথম এবং সমাপ্তি ছাড়া শেষ।’ (সূরা হাদিদ : ৩)।

এতে সময়ের ব্যাপকতা ও বিশালতা সহজে বোঝা যায়। দুনিয়ার জীবন সংক্ষিপ্ত বলেই আখেরাতের অনন্ত জীবনের গুরুত্ব দিতে হয়। আমার নির্দিষ্ট বয়সের সময় থেকে এক ঘণ্টা বা এক মিনিট চলে যাওয়া মানে প্রকৃত পক্ষে জীবনে একটা মূল্যবান অংশ কমে যাওয়া। সময় ওই জিনিস যা সবচেয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী, যদিও তা সবচেয়ে বেশি শ্লথ। আমরা সবাই তা অবজ্ঞা করি; যদিও পরে সবাই অনুশোচনা করি।

সময়ের যত ও মূল্যায়ন
ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ লোকেরা যা করতে অনিচ্ছুক তা করে সফল লোকেরা নিজেদের সময়ের সদ্ব্যবহার করে। সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সময় ব্যয় করার চেয়ে ব্যর্থতার গ্লানির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াকে সাধারণ মানুষ সহজতর মনে করে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবন ও সম্পদ দান করেছেন। যারা এটা দ্বীনের পথে ব্যয় করে তাদের তিনি জান্নাত দানের ওয়াদা দিয়েছেন, আর তিনি সময় ও শক্তির হিসাব নেবেন।

মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমত ওইসব দুর্ভাগ্যবান, মোহাবিষ্ট দলের লোক, যারা সব সময়ই আগামীকাল কোনো কাজ শুরু করতে চাই। দ্বিতীয়ত ওইসব বিস্ময়কর ব্যক্তি, যারা এখনই কাজ শুরু করতে প্রস্তুত। তাদের জন্য কোনো আগামীকাল নেই। ঈসা (আ.) বলেছেন, ‘জীবন তিন দিনের, গতকাল চলে গেছে, আগামী কাল বাঁচব কি না জানি না, বাকি আছে আজ। অতএব দৈনিক জীবনযাপন করো।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি দিনকে ভাগ করে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমাপ্তি করেছেন, তাই রাসুলুল্লাহর (সা.) এর জীবনের ‘একদিন’ এক একটি শতাব্দীর মতো মূল্যবান। লিলিয়ান ডিকসন বলেছিলেন, ‘জীবন হচ্ছে একটা মুদ্রার মতো, আপনি যেভাবে ইচ্ছা এটাকে খরচ করতে পারেন, তবে মনে রাখবেন এই খরচ করার সুযোগ আপনি মাত্র একবারই পাবেন।’ তাই গর্ববোধক কিছু করে প্রতিদিন অতিবাহিত করা উচিত।

জীবনে একবারই একটি দিন আসে। প্রতিদিন সকালে যখন আমরা ঘুম থেকে উঠি তখন আমাদের নোটবুক ২৪ ঘণ্টায় সমৃদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুজন ফেরেশতার এ আহ্বান ব্যতীত একটি প্রভাতও আসে না, হে আদম সন্তান, আমি একটি নতুন দিন, আমি তোমার কর্মের সাক্ষী। আমার থেকে একটি পাথেয় অর্জন করো। কেননা কেয়ামতের আগে আমি আর কখনও ফিরে আসব না।’ (রাওয়াহু রাজিন)। তাই জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সময়ভিত্তিক কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন।

পবিত্র কোরআনের সূরা মোমিনুনের ৩নং আয়াতে অর্থহীন কথা ও কাজ থেকে বিমুখ থাকতে বলা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা অনর্থক কথামালা বাজার থেকে ক্রয় করে (যেমন গান-বাজনা, নাটক, গল্প, ছায়াছবি কৌতুক ইত্যাদি), তাদের জন্য পীড়াদায়ক শাস্তির হুঁশিয়ার করা হয়েছে।’ (সূরা লোকমান : ৬)। আল্লাহর আনুগত্যে, দ্বীনি কাজে অলসতা, বিলম্ব করা, গাফিলতি করা, অপেক্ষা করা এতে জীবনের অধিকাংশ সময় হারিয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় মহা মূল্যবান সময়।

সময় নষ্ট করা শুধু অপরাধ বা অন্যায় নয়; বরং তা হচ্ছে আত্মহত্যার শামিল। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা নিজেদের হাতেই নিজেদের ধ্বংসের দিকে (অতলে) নিক্ষেপ করো না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আগাম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমাদের এমন যেন বলতে না হয় যে, ‘হায় আফসোস! আল্লাহ তায়ালার প্রতি আমার কর্তব্য পালনে আমি দারুণ শৈথিল্য প্রদর্শন করেছি, আমি ছিলাম ঠাট্টা-বিদ্রপকারীদেরই একজন।’ (সূরা জুমার : ৫৬)। তারপর সে তার অবশিষ্ট মূল্যবান জীবনে, গত জীবনের ক্ষতপিূরণে এমনভাবে অগ্রসর হয় যাতে আখেরাতের যে জজবা ও প্রেরণাকে এরই মধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে তা পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।

চোখের পানি ভাসিয়ে হলেও নিজের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করতে পারে এবং জীবনের বাকি সময়কে বহু মূল্যবান মনে করে যতটুকু সম্ভব চেষ্টাচরিত্র করতে পারে, আল্লাহ না করুন যদি এ সময়টুকুও হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে শুধু আক্ষেপ করা ছাড়া আর কোনো পথই সামনে খোলা থাকার নয়। মোমিনরা ঈমানের নূরে অনুধাবন করতে পারে সময়ের মূল্য ও গুরুত্ব। সে বুঝতে পারে যে, এটাই তার সফলতার পুঁজি বা মূলধন। কারণ শাস্তির দিনগুলোর ‘একদিন হবে পঞ্চাশ হজার বছরের সমান।’ (সূরা মায়ারিজ : ৪)। তাই সে আপন সময়ের এক সেকেন্ডও নষ্ট করে না। অতএব, আপনি যখনই বলছেন, আমার হাতে সময় নেই। আসলে আপনি বলেছেন যে, আপনার হাতে আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ আছে।

অবসর সময়
অব্যবহৃত বা হাতে থেকে যাওয়া সময় দিয়ে আপনি কি করেন! আপনি কি জানেন এ অতিরিক্ত সময়ের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করা যেতে পারে। কোরআনুল কারিম, হাদিস পূর্ণরূপে মুখস্থ করা যেতে পারে! বাসে, ট্রেনে, বিমানে ভ্রমণকালীন বা এর জন্য অপেক্ষাকালীন কয়েক মিনিট সময়ই এরূপ অতিরিক্ত, একে কি আপনি অতিরিক্ত বা সৃজনশীল সময় বলবেন? প্রতিদিনের ১৫ মিনিট মানে বছরের পূর্ণ ২২ দিন। কীভাবে সময় অতিবাহিত হয়। তাই ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে অবসরকে গুরুত্ব দিতে হবে। ‘অতঃপর আল্লাহ তাদের জিজ্ঞেস করবেন, বলো, দুনিয়ায় তোমরা কতদিন ছিলে? তারা বলবে একদিন বা একদিনের কিছু অংশ, হিসাবকারীদের কাছে (চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট) জিজ্ঞেস করে দেখুন, বলা হবে, অল্পকালই তোমরা ছিলে, হায় এ কথা যদি তোমরা সেই সময় (দুনিয়ায় থাকার সময়) জানতে, (কত ভালো হতো)।’ (সূরা মুমিনুন : ১১২-১২৪)।

আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসুলের আহ্বানে সাড়া দাও, যা তোমাদের সত্যিকার অর্থে জীবনদান করবে।’ (সূরা আনফাল : ২৪)। ‘যখন আপনি অবসর পান, পরিশ্রম করুন এবং আপনার রবের প্রতি মনোনিবেশ করুন।’ (সূরা ইনশিরাহ : ৭-৮)। ‘তোমার রবের ক্ষমা পাওয়ার জন্য দ্রুত ছুটে যাও।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৪)। ‘আল্লাহর দিকে যে আহ্বান জানাচ্ছে, তার ডাকে সড়া দাও।’ (সূরা আহকাফ : ৩১)। ‘তোমার রবের দিকে প্রত্যাবর্তন করো, তার অনুগত হও, তোমাদের ওপর আজাব আসার আগেই। অতঃপর কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ (সূরা জুমার : ৫৪)।

কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তায়ালা সব মানুষের কাছে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর চাইবেন। ১. তোমার (বয়স) জীবন কীভাবে শেষ করে ফেলেছ? ২. তোমার যৌবনের সময়টা কীভাবে কাটিয়েছ? ৩. তোমার ধনসম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছ? ৪. এই সম্পদ কীভাবে ব্যয় করেছ? ৫. যতটুকু ইলম শিক্ষা করেছ তা থেকে কি আমল করেছ? (তিরমিজি)। তাই আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য এই মৌখিক পরীক্ষার উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। রাসুলল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যাদ্দিদু ঈমানাকম’। অর্থ তোমাদের ঈমানকে নবায়ন করো। অধিক হারে আল্লাহর স্মরণ ও আনুগত্যে ঈমানকে তাজা করতে হয়। তরতাজা ঈমান সময়ের বেশি প্রয়োজন।

আমাদের চোখের সামনে আছে মহাগ্রন্থ ঘর-বাড়ি, গাছপালা, নদী, সাগর-মহাসাগর, পাহাড় পর্বত শহর-বন্দর, আকাশ বাতাস, চন্দ্র-সূর্য এসবই উন্মুক্ত গ্রন্থের সোনালি-রুপালি অক্ষর, শব্দ ও বাক্যাবলি থেকে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকেরা শিক্ষা নিয়ে থাকে। তাই আপনি সময় নেবেন এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে এটি ক্ষমতার উৎস। সময় নেবেন অধ্যয়নে এটি জ্ঞানের ভিত্তি। সময় নেবেন কাজ করতে এটি জীবনের ক্যারিয়ার। সময় নেবেন নামাজ আদায়ে এটি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি। সময় নেবেন আল্লাহর জিকিরে এটি রুহের অক্সিজেন। সময় নেবেন সময়ের মূল্য দিতে এটি জীবনের সাফল্য। সময় নেবেন কাঁদতে এটি জাহান্নোমের আগুন নিভিয়ে দেবে। সময় নেবেন সমাজকল্যাণে এটি নিজের জীবনের সাফল্য। কিন্তু সময় ক্ষেপণের জন্য কখনও সময় নেবেন না। সময়ের সঠিক মূর‌্যায়নে আল্লাহ আমাদের জীবন কামিয়াব করুন। আমিন।

লেখক : খতিব, বিন্নাপাড়া জামে মসজিদ রাজাপুর, ঝালকাঠি

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর